গুটি কয়েক খারাপ মানুষের জন্য জাতি তুলে গালি-গালাজ করা কি শোভনীয় ?
নজরুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ২:৪৪ পূর্বাহ্ণঅনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আদিবাসী,পাহাড়ি বা উপজাতিদেরকে নিয়ে আজ লিখব।
সম্প্রতি মুরগী ফার্মের যে যুবকটিকে তার ৫/৬ জন সহকর্মী বন্ধু (মার্মা সম্প্রদায়ের কয়েকজন দুষ্কৃতকারী) নির্মম ভাবে হত্যা করেছে, প্রথমে তাদের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সাথে সেই নরপশুদের যথাযথ শাস্তি দাবি করি।
সেই সাথে যারা এই ঘটনাকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন তাদেরকেও সতর্ক করে দিচ্ছি যে, না জেনে কোন কিছু বলা উচিত নয়।
আমি কেন আজ এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম ?
একটা বিষয় কোন মতেই গ্রহন করতে পারছি না যে, আদিবাসি মানুষেরা নাকি বাংগালির মাংস খেয়ে হাডডিগুলো জংগলে ফেলে দিয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন এই নোংরা উত্তেজনা সৃষ্টির পায়তারা ? এব্যাপারে কিছু বিষয় আপনাদের শেয়ার করতে চাই। সবাই কষ্ট করে পড়ে নিবেন এবং পারলে সবার সাথে শেয়ার করবেন।
দেখুন, কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি।
এখানে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কিছু পুরনো কথা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা এবং আমার এক ফুফাত ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা কাহিনী বলব।
আমার জন্ম পাহাড়ী এলাকায়,আমেরিকা আসার পূর্ব পর্যন্ত। এই পাহাড়িদের সংগেই আমার ছিল উঠাবসা এবং লেখাপড়া। সেই প্রাইমারী স্কুল হতে কলেজ পর্যন্ত বেশীর ভাগ শিক্ষকই ছিলেন চাকমা, ত্রিপুরা, মারমা আদিবাসি বা উপজাতি বা পাহাড়ি।
সেই আয়ুবের আমল থেকে চাকমাসহ সবাই বিভিন্নভাবে অবহেলিত হয়ে আসছে। ১৯৬২ সনে যখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মান করে কর্ণফুলীর পানি রাংগামাটি জেলার প্রায় দুই শত বর্গ মাইল সমতল ভুমিকে ডুবিয়ে দিয়েছে.তখন প্রায় ১ লক্ষ আদিবাসির জমিজমা ব্যবসা বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয় (বিনিময়ে এর সুফল এখন আমরা ভোগ করছি)। মনে পড়ে,তখন তাদেরকে ভাল করে বুঝানো হয়নি এবং খুবই সামান্য ক্ষতি পুরণ দেয়া হয়েছিল। আমার বাবার মুখে শুনেছি যেদিন রাংগামাটির সমতল এলাকায় পানি আসতো, তখন অনেকেই হাতে একটা দা সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ি গাছ,গাছরা কেটে কেটে পাহাড়ের উপড়ে উঠে জীবন বাচিয়েছে।
এই পাহাড়িরা এত সহজ-সরল ছিল যে, আইয়ুব সরকার যে সামান্য পয়সা দিয়েছিল সেই পয়সা দিয়ে সংসারের কোন কাজে লাগেনি, ওই পয়সা দিয়ে কেহ ছবি, দেখেছে কেউ বা রেডিও কিনেছে। আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না যে, রেডিওতে যখন আইয়ুব খাঁনের নাম উচ্চারণ করা হতো, তখন সেই সহজ সরল মানুষরা বলত, মগদার রেডিও মোর নাম নই কই আইয়ুব খান, আইয়ুব খান করেরদে। আবার কেউ বেশী পয়সা দিয়ে সিনেমার টিকেট কিনে সামনে গিয়ে বসত।
শেখ মুজিবুর রহমানের সময়, পাহাড়িদেরকে বলা হল তোমরা সবাই বাংগালি হয়ে যাও, তখন থেকে ওদের মনে ভয় ঢুকেছিল। তবে কি ওদের জাতি শেষ হয়ে যাবে ?
জিয়ার আমলে এসে বলা হল, না, আমরা পাহাড়িরা বিভিন্ন জাতি হতে পারি, কিন্তু আমাদের জাতীয়তা হল বাংলাদেশী। তবে তখনকার সময় সরকার বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাস্তহারা অসংখ্য বংগালীদের ডেকে এনে এনে পাহাড়ের বিভিন্ন খালি জায়গায় বসবাসের জন্য জায়গা করে দিল। এসময় কিছু সুযোগ সন্ধানী উগ্র লোভী বাঙ্গালী পাহাড়িদের অনেক জুম চাষের জমি ও সবজি বাগান, সবজি জবরদখল করে ভোগ করতে শুরু করে।
এরপর এরশাদের সময়ও পাহাড়িদের ওপর অবিচার অনাচার চলেছে। সেসময় সেনাবাহিনীকে এত সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা দেয়া হয় যে, তখন কিছু কিছু সেনা অফিসার সেই সুযোগে পাহাড়ি সুন্দরী মেয়েদের ভয দেখিয়ে ধরে নিয়ে যেতো, জোর করে বিয়ে করতো। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল, গাছ ও মাছের ব্যবসাগুলো একে একে সব সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়, বলতে গেলে জবরদস্তি করে ব্যবসাগুলো ওরাই করেছে। এমনও দেখেছি কোন কোন সেনা কর্মকর্তা অন্য কোথাও বদলীর আদেশ পেলে সেখানে না গিয়ে বরং চাকুরীই ছেড়ে দিত এবং মাছের ও গাছের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতো।
খালেদার সময় তেমন কোন কিছু হযেছে কিনা বলতে পারব না, কারন ওই সময়টাতেই আমি রাঙামাটির শৈশব ও যৌবনকালের মায়া কাটিয়ে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসি।
শেখ হাসিনার সরকার এসেই শান্তি চুক্তি করলেন। কিনতু আমি একটা বিষয় বুঝতে পারি নাই যে, ঐ চুক্তির সময় বাংগালিদের পক্ষে ছিলেন রাশেদ খান মেনন, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ অন্যান্য জেলার বড বড রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। অথচ দুঃখজনক যে, সেসময় রাংগামাটির পাহাড়ি কোন প্রতিনিধি না নেতাকে রাখা হয়নি। তাই এখনও সে অঞ্চলের সম্পুর্ণভাবে শান্তি ফিরে আসেনি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই ঐতিহাসিক চুক্তির জন্য অন্তর থেকে ধন্যবাদ।
এখন আসি আসল কথায়। এত কিছুর পরেও সম্প্রতি কিছু উগ্র উস্রংখল বাংগালির নেক্কার জনক তৎপরতা খুবই দুঃখজনক। এরা উপজাতি আদিবাসীদের সামাজিক মাধ্যমে ঢুকে যেসব মনগড়া কথা এবং নোংরা মন্তব্য করেছে, তা দেখে খুবই হতবাক ও মর্মাহত হলাম। আর একারনেই এই সব বিষয়গুলো না লিখে পারলাম না।
“উপজাতিরা মানুষের মাংস খায়” এই সব বাজে এবং বিশ্রী কথা কিভাবে এরা লিখে, বুঝতে পারি না। আরও অনেক বাজে কথা দেখেছি। সব উল্লেখ না-ই বা করলাম। তবে এটা বলব যে, ভালো মন্দ কোথায় নেই, আমাদের মদ্গ্যে যেমন মন্দ লক আছে, ঠিক তেমনই আদিবাসীর মধ্যেও থাকতে পারে, কিন্তু তাই সবাইকে গনহারে দোষারোপ করা কি আদৌ শোভনীয় হয়েছে ?
পরিশেষে কিছু কথা অভিগ্যতা শেয়ার করব।
১৯৮০/৮১ সনের দিকে যখন দংগদু এলাকায় প্রায় ৩/৪ শত বাংগালীকে পাহাডী (শান্তিবাহিনী) হত্যা করেছিল তখন মহালছড়ি পুলিশের জংগল স্কুল(পুলিশ ট্রেনিং)এর নতুন ভবন উদ্বোধনের সময় তৎকালীন মেজর জেনারের মনজুর সমাবেশে খুবই রাগ করেছিলেন। রাগের ভাষায় তার ভাষনে বলেছিলেন, আর যদি একজন বাংগালি মারা যায়, তা হলে তোমাদের আমি কাউকে ছাড়ব না, সবাইকে আঘাত করে ছাড়ব। তখন চারিদিকে যখন ফিসফিস আওয়াজ হতে লাগল, তখন আবার পরক্ষনেই তিনি নরম ও আবেগে কাঁদতে থাকলেন। এরপর বললেন, আমরা যুদ্ধ করে এই দেশ পেয়েছি এতগুলো মানুষের জীবন দেবার জন্য নয়, আমরা সবাই বাংলাদেশী, আমরা কেন নিজের দেশে এইভাবে একে অন্যকে হত্যা করব? আমরা সবাই ভাই এবং বন্ধু. এখন আমি যদি আমার সেনা বাহিনীকে বলি, এই সভা থেকে থেকে কিছু মানুষকে নিয়ে এসে হত্যা কর, তোমাদের কি কষ্ট হবে না ?
সবাই তখন বলল, হা।
তখন মুনজুর সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য শেষ করেছিলেন।
যখন শান্তিময় দেওয়ানেকে (উপজেলা চেযারম্যন) রিজার্ভ বাজারে হত্যাকরা হয়, সেই সময়ের গুলির আওয়াজ আমি শুনেছি, যখন
আব্দুর রশিদ ভাইকে বনরুপাতে উনার বাসায় হত্যা করা হয় তখনকার চিৎকারও আমি শুনেছি। আমার এক ভাইকে রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি রোডে কাজ করা অবস্থায় হত্যা করা হযেছে সেই কষ্ট এখনও ভুলতে পারি নাই।
এখানে কিছু ছবি দিয়েছি, দেখুন কত সহজ সরল এই চাকমা, ত্রিপুরা বা মারমা বন্ধুরা।
আমার স্কুলফ্রেন্ড দুইবার আটলানটা এসেছে দুইবারই আমার বাসায় এসে দেখা করেছে এখনও সবচেয়ে বেশী ফোনে কথা হয় তার সংগে,
আমেরিকা আসার সময় আমাকে বিদায় দেবার সময় বিদ্যুৎ ত্রিপুরা এবং কুনজুমনি চাকমাও উপস্তিত ছিল।
১৯৯৭ সনে বিয়ের পর প্রতিম রায়ের সংগে জীবনে প্রথম লংগদু গিয়ে তারপর ছোট্ট একটা নৌকা নিয়ে গভীর জলাশয় এবং জংগলের মধ্য দিয়ে গিয়ে নিঝুম একা একটি বাডীতে সারাদিন কাঠিয়ে এসেছি আমার নতুন বৌ এবং ছোট্ট দুটি বোনকে নিয়ে,যেখানে কোন কিছু হলে পৃথিবীর কোন মানুষের জানার কোন সাধ্যই ছিল না। প্রতিম ছিল আমার ক্লাসে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী (ক্লাস ক্যাপ্টন)। সবচেয়ে বড কথা আমি ছিলাম একমাত্র আমেরিকা প্রবাসী। তখন কত বাঙ্গালীদেরকে আটকে রেখে মুক্তিপন আদায় করা হযেছে, তার ইয়ত্তা নেই,কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনদিন ঐ সব চিন্তা বা ভয় ছিল না, কারন এই আদিবাসীদের সঙ্গেই আমরা একই সাথে বড হয়েছি, আমরা হিন্দু ,বৌদ্ধ,খৃস্টান ও মুসলমান একসংগে স্কুলে গিয়েছি, খেলাধুলা করেছি, কত যে আড্ডা দিয়েছি, বলে শেষ করা যাবে না। সবচেয়ে বড কথা, ঈদ, পুজা, বিজু ও বড়দিনে একে অপরের বাসায় গিয়েছি, কিন্তু এটা ঠিক যে, উৎসব যার যার আনন্দ ও তার তার. আমরা মেহমান হিসাবে সব সময় আমন্ত্রিত হয়েছি।
সবশেষে কত কয়েক বৎসর পূর্বে আমি আমাদের স্কুলের বন্ধুদের সংগে যোগাযোগ করে সবাই মিলে একটা ভিডিও কলের ব্যবস্থা করেছিলাম। তখনও চাকমা বন্ধুর সংখ্যাই বেশী ছিল, ফোন যখন করি, একজন আদিবাসী বন্ধু বলল, নজরুল তুমি কি জানো যেদিন শুনেছি আমরা সবাই ফোনে কথা বলব, সেদিন আমার মেয়ে বলছে মা তুমি এত খুশি কেন? মেয়ে নাকি বলেছে তোমাকে এত খুশি হতে অনেকদিন দেখিনি.এটাই হল আমাদের বন্ধুত্ব। সবচেয়ে বড কথা আমরা সবাই মানুষ। আরও অনেক কিছু লিখার ছিল। আজ এখানেই শেষ করছি।
কাজেই শতকরা ১% খারাপ মানুষের জন্য সবাইকে জাতি ধরে গালি বা দোষ দেয়া উচিত নয়।
এখানে আমি শুধু আমার জানা এবং দেখা কাহিনী উল্লেখ করলাম। ভুল হলে ক্ষমা করে দিবেন।