দেশের প্রথম রেলস্টেশন
মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৪০ পূর্বাহ্ণসময়টা ঊনবিংশ শতাব্দী, ব্রিটিশ শাসনামল। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি ব্রডগেজ রেলপথ ধরে পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট থেকে একটি ট্রেন এসে থামলো কুষ্টিয়ার এক রেলস্টেশনে, নাম ‘জগতি’।
১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ওইদিনই প্রথম রেলগাড়ি চললো বর্তমান বাংলাদেশ তখন ভারতবর্ষে শুধু অর্থনৈতিক কাজে রেলপথ চালু করেছিল ব্রিটিশরা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তাই কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে জগতিতে রেলপথ ও স্টেশন নির্মিত হয়। পরে ‘কুষ্টিয়া চিনিকল’ প্রতিষ্ঠিত হলে আখ সরবরাহে ব্যবহৃত হতো এই রেলস্টেশন।
১৬০ বছর বয়সি এ স্টেশনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯১ সালে। চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করে এসে ভর্তি হলাম শহরতলীর জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখনও জানতাম না জগতি নামটা উপমহাদেশের একটা অন্যতম পরিচিত নাম। আর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেলস্টেশনেরও নাম।
আমাদের বিদ্যালয় ভবনটা ছিল ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আকৃতির। আর এর পেটের মধ্যে ছিল ‘আই’ আকৃতির প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। রাস্তার পাশের অফিস ভবনটা ছাড়া আমাদের বিদ্যালয়ের বাকি সব কক্ষ ছিল সেমিপাকা ভবন। একটা অংশের উপর ছিল টিনের ছাপড়া, অন্য অংশটার উপর ছিল টিনের চৌচালা। একটু বৃষ্টি হলেই টিনের চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে আমাদের বসার বেঞ্চ ভিজিয়ে দিত। তখন আমাদের সরে সরে বসতে হতো। আর বেশি বৃষ্টি হলে কক্ষের মধ্যে বন্যা বয়ে যেত।
আমাদের মেঝে ছিল ইটের সোলিং করা, তাই পানি বেশিক্ষণ জমে থাকতে পারতো না। বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার পাশেই রেললাইনের জায়গায় খাল। আর খালের অপর পাড়েই রেললাইন। আমাদেরকে তাই রেলগাড়ি দেখতে আর দূরে যেতে হতো না।
রেলগাড়িগুলো জগতি স্টেশনে এসে থামতো। তারপর সেখান থেকে আরো মালামাল এবং মানুষ নিয়ে যাত্রা করতো। যাত্রা শুরুর আগে স্টেশনঘরের পাশে ঝোলানো রেলের পাতে সজোরে একটানা আঘাত করে জানিয়ে দেওয়া হতো কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে যাবে। বিদ্যালয়ে বসেও আমরা এই ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেতাম।
জগতি স্টেশনের অপর পাশেই ছিল রেলবাজার। সবসময় সরগরম থাকতো রেলবাজার। আশপাশের এলাকার মানুষেরা নির্দিষ্ট দিনে এখানে বাজার করতে আসতেন। আর ছিল জগতি হাট। সেখানেই সপ্তাহের দুইদিন হাট বসতো। তখন অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো হাট করতে।
আমাদের বিদ্যালয়ের দেয়ালের পেছনে রাস্তার ধারে ছিল জগতি ডাকঘর। সেখানেও ব্যস্ততা থাকতো সারাদিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠি সংগ্রহ করে সেগুলোকে কুষ্টিয়া সদরে নিয়ে যাওয়া, আবার সদর থেকে বস্তাভর্তি চিঠি নিয়ে এসে বিলি করার তোড়জোড় চলতো সারাদিন। অনেকেই সরাসরি ডাকঘরে এসে খোঁজ নিতেন তাদের কোন চিঠি এসেছে কিনা! আমাদেরকেও বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছিল আব্বার চিঠি এসেছে কিনা জানার জন্য। পোস্টমাস্টারের ছেলেমেয়েরা আমাদের সঙ্গেই বিদ্যালয়ে পড়তো।
সেই জগতি স্টেশনে অনেকদিন পর বেড়াতে গেলাম। আগে স্টেশনের কাছাকাছি এলে লোকজনের গমগম আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন স্টেশনে মানুষই খুঁজে পাওয়া দায়। স্টেশনের অপেক্ষাঘর ফাঁকা পড়ে আছে। ট্রেনের তালিকা বোর্ডে কবেকার পুরনো ট্রেনের সময়সূচি। তার উপর কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে ইংরেজিতে স্টেশনের নামটা লিখে রেখেছে- ‘জগতি’!
স্টেশনের ঘণ্টাটা এখন বড্ড নিঃসঙ্গ। পানির ট্যাংকের উপর জন্মেছে বটের চারা। সেটাকে আর পানির ট্যাংক বলে চেনার উপায় নেই। অনেকক্ষণ ধরে স্টেশনে হাঁটাহাঁটি করলাম, কিন্তু কোন যাত্রী বা রেলগাড়ির দেখা পেলাম না।
তারপর গেলাম রেলবাজারে। সেখানেও মানুষের আনাগোনা খুব কম। বাজারের পাশে ছিল ভিসিআরের দোকান। সেটা উঠে গেছে অনেক আগেই। তারপর গেলাম বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পুকুরপাড়ে লাগানো বটগাছটা ধীরে ধীরে মহীরুহের আকার নিচ্ছে। বিদ্যালয়ের ভবন এখন পাকা হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল এবং নাম সম্বলিত সুদৃশ্য ফটক।
আরও নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার। ডাকঘরটা এখনো আছে, কিন্তু কোন জনমানুষের দেখা পেলাম না। ডাকঘর পার হয়ে ‘দয়াল বেকারি’ নামে একটা বেকারি ছিল, সেটাও আর নেই এখন। হেঁটে হেঁটে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। চৌড়হাঁস মতি মিঞার রেলগেটে এসে দেখা পেলাম রেলগাড়ির।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় প্রকৃতি, বদলায় মানুষ। কিন্তু মানুষ নির্মিত স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই স্থাপনাগুলোর গায়ে কতশত মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প লেখা থাকে। জগতি রেলস্টেশনও এমন এক জাতিস্মরের নাম।
অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি পুরোনো স্থাপনাগুলোকে ঐতিহ্য ঘোষণা করে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যে স্টেশনগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে সেগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে, হয়তোবা কান পেতে শুনে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতিধ্বনি।
জগতি স্টেশনের অপর পাশেই ছিল রেলবাজার। সবসময় সরগরম থাকতো রেলবাজার। আশপাশের এলাকার মানুষেরা নির্দিষ্ট দিনে এখানে বাজার করতে আসতেন। আর ছিল জগতি হাট। সেখানেই সপ্তাহের দুইদিন হাট বসতো। তখন অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো হাট করতে।
আমাদের বিদ্যালয়ের দেয়ালের পেছনে রাস্তার ধারে ছিল জগতি ডাকঘর। সেখানেও ব্যস্ততা থাকতো সারাদিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠি সংগ্রহ করে সেগুলোকে কুষ্টিয়া সদরে নিয়ে যাওয়া, আবার সদর থেকে বস্তাভর্তি চিঠি নিয়ে এসে বিলি করার তোড়জোড় চলতো সারাদিন। অনেকেই সরাসরি ডাকঘরে এসে খোঁজ নিতেন তাদের কোন চিঠি এসেছে কিনা! আমাদেরকেও বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছিল আব্বার চিঠি এসেছে কিনা জানার জন্য। পোস্টমাস্টারের ছেলেমেয়েরা আমাদের সঙ্গেই বিদ্যালয়ে পড়তো।
সেই জগতি স্টেশনে অনেকদিন পর বেড়াতে গেলাম। আগে স্টেশনের কাছাকাছি এলে লোকজনের গমগম আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন স্টেশনে মানুষই খুঁজে পাওয়া দায়। স্টেশনের অপেক্ষাঘর ফাঁকা পড়ে আছে। ট্রেনের তালিকা বোর্ডে কবেকার পুরনো ট্রেনের সময়সূচি। তার উপর কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে ইংরেজিতে স্টেশনের নামটা লিখে রেখেছে- ‘জগতি’!
স্টেশনের ঘণ্টাটা এখন বড্ড নিঃসঙ্গ। পানির ট্যাংকের উপর জন্মেছে বটের চারা। সেটাকে আর পানির ট্যাংক বলে চেনার উপায় নেই। অনেকক্ষণ ধরে স্টেশনে হাঁটাহাঁটি করলাম, কিন্তু কোন যাত্রী বা রেলগাড়ির দেখা পেলাম না।
তারপর গেলাম রেলবাজারে। সেখানেও মানুষের আনাগোনা খুব কম। বাজারের পাশে ছিল ভিসিআরের দোকান। সেটা উঠে গেছে অনেক আগেই। তারপর গেলাম বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পুকুরপাড়ে লাগানো বটগাছটা ধীরে ধীরে মহীরুহের আকার নিচ্ছে। বিদ্যালয়ের ভবন এখন পাকা হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল এবং নাম সম্বলিত সুদৃশ্য ফটক।
আরও নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার। ডাকঘরটা এখনো আছে, কিন্তু কোন জনমানুষের দেখা পেলাম না। ডাকঘর পার হয়ে ‘দয়াল বেকারি’ নামে একটা বেকারি ছিল, সেটাও আর নেই এখন। হেঁটে হেঁটে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। চৌড়হাঁস মতি মিঞার রেলগেটে এসে দেখা পেলাম রেলগাড়ির।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় প্রকৃতি, বদলায় মানুষ। কিন্তু মানুষ নির্মিত স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই স্থাপনাগুলোর গায়ে কতশত মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প লেখা থাকে। জগতি রেলস্টেশনও এমন এক জাতিস্মরের নাম।
অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি পুরোনো স্থাপনাগুলোকে ঐতিহ্য ঘোষণা করে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যে স্টেশনগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে সেগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে, হয়তোবা কান পেতে শুনে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতিধ্বনি।
মো. ইয়াকুব আলীঃ লেখক ও পুরকৌশলী, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। প্রকাশিত বইঃ ‘নদীর জীবন’, ‘অস্ট্রেলিয়ার ডায়েরি’ এবং ‘অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে’।